Wednesday, July 10, 2024

ভালো ও মন্দ মানুষ নিয়ে মহানবী সা. যা বলেছেন

 


মানুষ আল্লাহ তায়ালার সেরা সৃষ্টি। মানুষের মতো বোধ শক্তি অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেওয়া হয়নি। এ কারণে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত বলা হয়।  পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।’ (সূরা ত্বীন, আয়াত : ৪)।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব কিভাবে- এ বিষয়ে বিখ্যাত সুফী আল্লামা ইবনে আরবি বলেন, আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্যে মানুষের থেকে সুন্দর আর কেউ নেই। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তাকে জ্ঞান ও শক্তি দিয়েছেন, এবং তাকে কথা বলা, কথা শোনা, দৃষ্টি শক্তি দিয়েছেন। এবং তাকে কৌশল অবলম্বন ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী।

আল্লাহ তায়ালার দেওয়া জ্ঞান ও শক্তির অপব্যবহার করে অনেকে সৃষ্টির সেরা থেকে সর্ব নিকৃষ্ট বস্তুতেও পরিণত মানুষ। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তারা (মানুষ হয়েও) পশুর মতো, বরং পশুর চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট।’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ১৭৯)

মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে কিছু গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে এবং আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের যথাযথভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে। মানুষের মধ্যে কে সর্বোত্তম আবার কে নিকৃষ্ট এ নিয়ে বেশ কিছু হাদিসে আলোচনা করেছেন রাসূল সা.। এক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা রা. সূত্রে বর্ণিত— 


Wednesday, July 3, 2024

كِتٰبٌ اُنۡزِلَ اِلَیۡكَ فَلَا یَكُنۡ فِیۡ صَدۡرِكَ حَرَجٌ مِّنۡهُ لِتُنۡذِرَ بِهٖ وَ ذِكۡرٰی لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ

كِتٰبٌ اُنۡزِلَ اِلَیۡكَ فَلَا یَكُنۡ فِیۡ صَدۡرِكَ حَرَجٌ مِّنۡهُ لِتُنۡذِرَ بِهٖ وَ ذِكۡرٰی لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ



এটি কিতাব, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তার সম্পর্কে তোমার মনে যেন কোন সংকীর্ণতা না থাকে। যাতে তুমি তার মাধ্যমে সতর্ক করতে পার এবং তা মুমিনদের জন্য উপদেশ। আল-বায়ান

এটি একটি কিতাব যা তোমার উপর নাযিল করা হয়েছে, এ ব্যাপারে তোমার অন্তরে যেন কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ না হয়, (এটা নাযিল করা হয়েছে অমান্যকারীদেরকে) এর দ্বারা ভয় প্রদর্শনের জন্য এবং মু’মিনদেরকে উপদেশ প্রদানের জন্য। তাইসিরুল

এ একটি কিতাব যা তোমার উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, সুতরাং তোমার অন্তরে যেন মোটেই সংকীর্ণতা না আসে। আর মু’মিনদের জন্য এটা উপদেশ। 


২. এ কিতাব(১) আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে, সুতরাং আপনার মনে যেন এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ(২) না থাকে। যাতে আপনি এর দ্বারা সতর্ক করতে পারেন।(৩) আর তা মুমিনদের জন্য উপদেশ।

(১) কিতাব বলতে এখানে কি বোঝানো হয়েছে এ ব্যাপারে সবচেয়ে স্বচ্ছমত হল- পবিত্র কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। [বাগভী] কারো কারো মতে এখানে শুধু এ সূরার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

(২) হারাজ হবার মানে হচ্ছে এই যে, বিরোধিতা ও বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার না দেখে মানুষের মন সামনে এগিয়ে চলতে পারে না; থেমে যায়। তাই মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানে ‘হারাজ’ বলে ‘সন্দেহ' বুঝানো হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়বস্তুকে ‘দাইকে সদর’ শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল-হিজরঃ ৯৭, সূরা আন-নাহলঃ ১২৭, সূরা আন-নামলঃ ৭০, সূরা হুদঃ ১২।

(৩) এ আয়াতে কাদেরকে সতর্ক করতে হবে তা বলা হয়নি। অন্য আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ বলেন, “এবং বিতণ্ডাপ্রিয় সম্প্রদায়কে তা দ্বারা সতর্ক করতে পারেন।” [মারইয়াম: ৯৭] আরও বলেন, “বস্তুত এটা আপনার রব-এর কাছ থেকে দয়াস্বরূপ, যাতে আপনি এমন এক কওমকে সতর্ক করতে পারেন, যাদের কাছে আপনার আগে কোন সতর্ককারী আসেনি, যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে। [আল-কাসাস: ৪৬] আরও বলেন, “বরং তা আপনার রব হতে আগত সত্য, যাতে আপনি এমন এক সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারেন, যাদের কাছে আপনার আগে কোন সতর্ককারী আসেনি, হয়তো তারা হিদায়াত লাভ করবে। [সূরা আস-সাজদাহ: ৩] অনুরূপভাবে এ আয়াতে কিসের থেকে সতর্ক করতে হবে তাও বলা হয়নি। অন্যত্র তা বলে দেয়া হয়েছে, যেমন, “তার কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য।” [সূরা আল-কাহাফ: ২] “অতঃপর আমি তোমাদেরকে লেলিহান আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি [সূরা আল-লাইল: ১৪] এ আয়াতে ভীতিপ্রদর্শন এবং সুসংবাদ প্রদান একসাথে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভীতিপ্রদর্শন কাফেরদের জন্য আর সুসংবাদ মুমিনদের জন্য। [আদওয়াউল বায়ান]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২) তোমার নিকট কিতাব অবতীর্ণ

করা হয়েছে; সুতরাং তোমার মনে যেন এর সম্পর্কে কোন প্রকার সংকীর্ণতা না থাকে।[1] যাতে তুমি এর দ্বারা সতর্ক কর এবং বিশ্বাসীদের জন্য এটি উপদেশ।

[1] অর্থাৎ, এর প্রচারের ব্যাপারে তোমার অন্তরে এই মনে করে যেন সংকীর্ণতা সৃষ্টি না হয় যে, হয়তো কাফেররা আমাকে মিথ্যাবাদী ভাববে, আমাকে কষ্ট দেবে। কারণ, মহান আল্লাহই হলেন তোমার রক্ষাকর্তা ও সাহায্যকারী। অথবা حَرَج অর্থ, সন্দেহ। অর্থাৎ, এটা যে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ করা হয়েছে -এ ব্যাপারে যেন তুমি তোমার অন্তরে সন্দেহ অনুভব না কর। এখানে নিষেধ-সূচক বাক্য দিয়ে নবীকে সম্বোধন করা হলেও প্রকৃতার্থে সম্বোধন করা হয়েছে উম্মতকে। অর্থাৎ, তারা যেন সন্দেহ না করে।

 

Sunday, June 30, 2024

আল্লাহর বাণীঃ

 


আল্লাহর বাণীঃ

আল্লাহর বাণীঃ তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহতোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু বুঝে সুঝে যে সব শপথ তোমরা কর তার জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। (এ পাকড়াও থেকে অব্যাহতির) কাফফারা হল দশ জন মিসকিনকে মধ্যম মানের খাদ্যদান যা তোমরা তোমাদের স্ত্রী পুত্রকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদেরকে বস্ত্রদান অথবা একজন ক্রীতদাস মুক্তকরণ। আর এগুলো করার যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। এগুলো হল তোমাদের শপথের কাফফারা যখন তোমরা শপথ কর। তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর। (সূরাহ আল-মায়িদাহ ৫/৮৯)


কারো উপর মৃত ব্যক্তির ঋণের ভার হাওয়ালা করা জায়েয।

 সালামাহ ইবনু আকওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, একদিন আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় একটি জানাযা উপস্থিত করা হল। সাহাবীগণ বললেন, আপনি তার জানাযার সালাত আদায় করে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার কি কোন ঋণ আছে? তারা বলল, না। তিনি বললেন, সে কি কিছু রেখে গেছে? তারা বলল, না। তখন তিনি তার জানাযার সালাত আদায় করলেন। তারপর আরেকটি জানাযা উপস্থিত করা হল। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি জানাযার সালাত আদায় করে দিন। তিনি বললেন, তার কি কোন ঋণ আছে? বলা হল, হ্যাঁ, আছে। তিনি বললেন, সে কি কিছু রেখে গেছে? তারা বললেন, তিনটি দ্বীনার। তখন তিনি তার জানাযার সালাত আদায় করলেন। তারপর তৃতীয় আরেকটি জানাযা উপস্থিত করা হল। সাহাবীগণ বললেন, আপনি তার জানাযা আদায় করুন। তিনি বলেন, সে কি কিছু রেখে গেছে। তারা বললেন, না। তিনি বললেন, তার কি কোন ঋণ আছে। তারা বললেন, তিন দ্বীনার। তিনি বললেন, তোমাদের এ লোকটির সালাত তোমরাই আদায় করে নাও। আবূ কাতাদাহ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তার জানাযার সালাত আদায় করুন, তার ঋণের জন্য আমি দায়ী। তখন তিনি তার জানাযার সালাত আদায় করলেন।

Saturday, June 29, 2024

হজরত বেল্লাল রা: করুন কাহীনি

 

নতুন ধর্ম ইসলামের আলো যখন মক্কা নগরী আলোকিত হয়ে উঠল, মহানবী সা: যখন কালেমার দাওয়াত প্রচার শুরু করলেন, হজরত বেলাল রা: তখন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। এমন এক সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, যখন পৃথিবীর বুকে তিনি এবং কয়েকজন লোক ছাড়া আর কোনো মুসলিমদের অস্তিত্ব ছিল না। ইসলাম গ্রহণকারী প্রভাবশালীদের ওপর মুশরিক নেতৃবৃন্দ কোনো নির্যাতন করার সাহস পায়নি। কারণ, বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো শক্তিশালী আত্মীয়স্বজন ছিল। পক্ষান্তরে দুর্বল দাস-দাসীদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব ছিল না। ফলে অসহায়- দুর্বলদের ওপর কুরাইশ নেতারা চাপিয়েছে নির্যাতনের পাহাড়। এ অসহায় লোকদের ওপর নির্যাতন চালানোর দায়িত্ব নিয়ে ছিল একদল কঠিন ও নির্দয় কুরাইশি কাফের। আবু জাহল হজরত সুমাইয়্যা রা: কে হত্যা করে এ দায়িত্ব পালনে সর্বপ্রথম কৃতিত্ব দেখায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই পাষণ্ড হৃদয় কাফেরদের অত্যাচার ছিল চরম অমানবিক। বেলাল রা:কে নির্যাতন করার দায়িত্ব নিয়েছিল উমাইয়া ইবনে খলফ এবং তার পাষাণ হৃদয়ের কিছু সঙ্গী। তারা চাবুকের আঘাতে তাকে রক্তাক্ত করত আর তিনি বলতেন, আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। আহাদ, আহাদ। তারা তার বুকের ওপর চাপিয়ে দিত বড় বড় পাথর আর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তিনি বলতেন, আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। আহাদ, আহাদ।

      তারা যতই তার কষ্টকে তীব্র করে তুলত তিনি বলতেন, এ একটি কথাই। আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। আহাদ, আহাদ। তারা তাকে জোরাজুরি করত লাত, উজ্জা দেবদেবীর নাম নিতে। কিন্তু তিনি অবিরাম শুধু আল্লাহ ও মুহাম্মদ নামই উচ্চারণ করতেন। তারা বলত, আমরা যেভাবে আমাদের দেবদেবীর নাম জপ করি তুইও সেভাবে কর। বেলাল রা: জবাবে বলতেন, ওইগুলো আমি ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারি না। এ কথা শুনেই তারা তাকে আরো বেশি কষ্ট দিত। আরো ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালাত। পাপিষ্ঠ উমাইয়া যখন নির্যাতন চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখন হজরত বেলাল রা:-এর গলায় মোটা রশি বেঁধে দুষ্ট বালকদের হাতে তুলে দিয়ে বলত, একে মক্কার পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনার অপরাধে বেলাল রা:কে যখন এভাবে গলায় রশি বেঁধে নেয়া হতো, এই কষ্ট তার কাছে খুব মজাদার লাগত। তিনি তখন ঈমানের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতেন আর জান্নাতি সঙ্গীত গাইতেন আহাদ, আহাদ। আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। তিনিই আমার রব। তিনিই আমার সব। অবিরাম চলতে থাকত তার মুখের এই সুমধুর সুর। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন।

Friday, June 28, 2024

মহান আল্লাহর বাণীঃ badorer judhha

 


মহান আল্লাহর বাণীঃ

(إِذْ تَسْتَغِيْثُوْنَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّيْ مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلٰٓئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ (9) وَمَا جَعَلَهُ اللهُ إِلَّا بُشْرٰى وَلِتَطْمَئِنَّ بِهٰ قُلُوْبُكُمْ ط وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِنْدِ اللهِ ط إِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ  (10) إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُمْ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً لِّيُطَهِّرَكُمْ بِهٰ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطٰنِ وَلِيَرْبِطَ عَلٰى قُلُوْبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الْأَقْدَامَ  (11) إِذْ يُوْحِيْ رَبُّكَ إِلَى الْمَلٰٓئِكَةِ أَنِّيْ مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا ط سَأُلْقِيْ فِيْ قُلُوْبِ الَّذِيْنَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوْا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوْا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ  (12) ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ شَآقُّوا اللهَ وَرَسُوْلَه” ج وَمَنْ يُّشَاقِقِ اللهَ وَرَسُوْلَه” فَإِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ (13))

স্মরণ কর, তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করছিলে তোমাদের রবের কাছে, তিনি তোমাদের প্রার্থনার জবাবে বললেনঃ অবশ্যই আমি তোমাদের সাহায্য করব এক হাজার মালায়িকাহ দিয়ে, যারা ক্রমান্বয়ে এসে পৌঁছবে। আর আল্লাহ্ এ সাহায্য করলেন শুধু সুসংবাদ দেয়ার জন্য এবং যেন তোমাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। আর সাহায্য তো কেবল আল্লাহর তরফ হতেই হয়। নিশ্চয় আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, হিকমাতওয়ালা। স্মরণ কর, আল্লাহ্ তোমাদেরকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করেন নিজের পক্ষ হতে স্বস্তি প্রদানের জন্য এবং তোমাদের উপর আসমান হতে পানি বর্ষণ করেন তা দিয়ে তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য এবং যাতে তোমাদের হতে অপসারিত করে দেন শায়ত্বনের কুমন্ত্রণা, আর যাতে তোমাদের অন্তর সুদৃঢ় করেন এবং যার ফলে তোমাদের পা স্থির করে দিতে পারেন। স্মরণ কর, তোমার রব মালায়িকাহ্কে প্রত্যাদেশ করেন- নিশ্চয় আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, সুতরাং তোমরা মুমিনদের দৃঢ়চিত্ত রাখ। অচিরেই আমি কাফিরদের অন্তরে আতংক সঞ্চার করে দেব, অতএব, আঘাত কর তাদের গর্দানের উপর এবং আঘাত কর তাদের অঙ্গুলির জোড়ায় জোড়ায়। (সূরাহ আনফাল ৮/-১৩)

Wednesday, June 26, 2024

ওমর ফারুক (রা.) শাসনব্যবস্থা

 



ওমর ফারুক (রা.)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। অর্ধ পৃথিবীর শাসক। নবী (সা.) এর প্রিয় সাহাবি। তিনি ন্যায়নীতিতে ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। অন্যায়ের প্রতিবাদে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য বীরসেনানী। তার নাম শুনলে সে যুগের বড় বড় বীর বাহাদুরের গলা শুকিয়ে যেত ভয়ে। কারণ তিনি ছিলেন যুগখ্যাত অকুতোভয় সিপাহসালার। মরণজয়ী মুজাহিদ। ওমর ফারুক (রা.) ছিলেন ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম রূপকার। খলিফা হিসেবে আমিরুল মোমেনিন ছিল তার উপাধি।


বংশ পরিচিতি


ওমর ফারুক (রা.) হস্তীবাহিনীর ঘটনার ১৩ বছর পর ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ গোত্রের শাখা বনু আদির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খাত্তাব ইবনে নুফায়েল এবং মাতা হানতামা বিনতে হিশাম। কা’ব ইবনে লুয়াইয়ের মাধ্যমে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে তার বংশধারা মিলে যায়। (তারিখুল ইসলাম, যাহাবি : ৩/২৫৩, সীরাতু আমিরিল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : পৃ.১২-১৩, তারিখে উম্মাতে মুসলিমা : ৩/৯২)।


শৈশশ ও যৌবনের প্রথম প্রহর


শৈশবে তার পিতা তাকে উট চড়ানোর কাজে লাগিয়ে দেন। তখন মক্কার খুব কম লোকই লেখাপড়া জানত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি লেখাপড়া শিখেছেন। যৌবনের শুরুতে তিনি ব্যবসা করতেন। সেই সুবাধে আরবের বাইরেও তিনি সফর করেন। এজন্য পৃথিবীর ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থা এবং তাদের জীবন কালচার ও আচার-ব্যবহার সম্পর্কে তার ভালো জানাশোনা ছিল। কুরাইশের লোকেরা তার সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে ভালোই অবগত ছিল। তাই অল্প বয়সেই তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। (তারিখে উম্মাতে মুসলিমা : ৩/৯৩)।


ইসলাম গ্রহণ


যৌবনের শুরুতে তিনি ইসলামের কট্টর বিরোধী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের ভাষ্য মতে ২৮ বছর বয়সে নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছর ইসলাম গ্রহণ করেন। সে সময় নারীপুরুষ মিলে মাত্র ৪০ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২/৩৭০ সীরাতু আমিরিল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : ২০)।


খেলাফতকাল


ওমর (রা.) ১৩ হিজরি থেকে ২৪ হিজরি মোতাবেক ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফার দায়িত্ব পালন করেন। খেলাফত লাভের পর তিনি একটি ভাষণ দেন। সে ভাষণে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি দুর্বল, আমাকে শক্তি দাও। হে আল্লাহ! আমি রূঢ় মেজাজি, আমাকে কোমলপ্রাণ বানাও। হে আল্লাহ! আমি কৃপণ, আমাকে দানশীল বানাও।’ (মানাকিবু আমিরুল মোমেনিন : ১৭০-১৭১, সীরাতু আমিরুল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : ৭০)।


ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা


ইসলামি খেলাফতের ধারাবাহিকতা প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) থেকে শুরু হয়। কিন্তু অধিক সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলভাবে হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর সময় ইসলামি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তিনি শুধু একজন বিজেতাই ছিলেন না, তদানীন্তন দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যবাদকে পরাভূত করে তাদের সাম্রাজ্যকে ইসলামি রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত করেন এবং একটি কল্যাণমূলক প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সব অঞ্চলের ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন ও অগ্রগতির নীতিমালাই ছিল প্রধান রাষ্ট্রীয় নীতি। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থ হলো, সরকারি সেবার পরিধি বাড়ানো যা হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে পূর্ণরূপ বাস্তবায়িত হয়েছিল।


বিজিত দেশসমূহ


হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর খেলাফত আমলে যে সমস্ত দেশ, প্রদেশ ও অঞ্চল বিজিত হয়, সেগুলোর মধ্যে পারস্য, ইরাক, খুরাসান, বেলুচিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, আর্মেনিয়া প্রভৃতি রয়েছে। তার দশ বছরের খেলাফত আমলে যে বিজয় অর্জিত হয়, তা ছিল অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে হিজরি ২২ সনে তিনি ইসলামি রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।


প্রাদেশিক বিভক্তি


আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা মতে তার খেলাফত বিস্তৃত ছিল মক্কা মুকাররমাহ, মদিনা মুনাওয়ারাহ, সিরিয়া, জাজিরা, বসরা, কুফা, মিসর, ফিলিস্তিন, খুরাসান, আজারবাইজান ও পারস্যজুড়ে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো প্রদেশের আয়তন ছিল দুটি প্রদেশের সমান। কোনো কোনো প্রদেশের আবার দু’দুটি কেন্দ্র ছিল এবং প্রত্যেকটি কেন্দ্রে পৃথক পৃথক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল। প্রত্যেক প্রদেশের, একজন ওলী বা কর্মকর্তা, একজন কাতিব (সচিব) বা মীর মুনশী, একজন সেনানায়ক, একজন সাহিবুল খারাজ বা কালেক্টর, একজন পুলিশ অফিসার, একজন ট্রেজারি অফিসার এবং একজন বিচারক অবশ্যই থাকত। এভাবে তার খেলাফত হয়ে উঠেছিল সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল। (তারিখুল ইসলাম আকবর শাহ নজিবাবাদি : ১/৩৫৩)।


প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্য ও কাঠামো


ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ছিল চারটি: কোরআন, হাদিস, ইজমা, ও কিয়াস। তার শাসনব্যস্থায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ছিল না। ধনী গরিবের মাঝে পার্থক্য ছিল না। তাকওয়ারভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ নির্ণিত হতো। ধনী-গরিব সবাই ন্যায্য ও প্রাপ্য অধিকার পেত। কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে চলত বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগ ছিল স্বাধীন। কাজি তথা বিচারকের ইনসাফপূর্ণ ফয়সালাই হতো চূড়ান্ত বিচার। বিচারকার্যে খলিফা তথা ইসলামি সাম্রাজ্যের সম্রাট ওমর ফারুক (রা.) এর ছিল না কোনো হস্তক্ষেপ। তবে তিনি অতি জটিল ও কঠিন সমস্যার সমাধান করতেন নিজ হাতে আন্তরিকতা ও ইনসাফের সঙ্গে। তার শাসনামলে জননিরাপত্তা ছিল আশাতীত। তার প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ইসলামি জাতীয়তাবাদ, কর্মকর্তাদের আচরণবিধি প্রণয়ন, নগরবাসীর মতামত গ্রহণের মাধ্যমে শাসন পরিচালনা, শাসনের ব্যাপারে সবাই সমান, নীতিনির্ধারক হিসেবে মজলিসে শূরার অগ্রগণ্যতাসহ আরো কিছু যুগান্তকারী ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারক সিদ্ধান্ত।


শাসনতান্ত্রিক সংস্কার : হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো, কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা, পুলিশ বিভাগ প্রতিষ্ঠা, জেলখানা নির্মাণ, গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।


রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয় : হজরত ওমর (রা.) রাষ্ট্রীয় আয়ের কয়েকটি উৎস নির্ধারণ করেন। যেমন, রাজস্ব ব্যবস্থা, বায়তুল মাল, মুদ্রা সংস্কার, ভূমিকর নির্ধারণ, দিওয়ানুল খারাজ, কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণ ও আদম শুমারি ইত্যাদি।


অনন্য বৈশিষ্ট্য


ওমর ফারুক (রা.) ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। শাসক ও সমরনায়ক হিসেবে সফল ব্যক্তিত্ব। দুঃখী মানুষের কান্না তাকে কাতর করে তুলত। শাসন ক্ষমতা পেয়ে জনতার অধিকার আদায় করতে না পারার কারণে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ভয় তার হৃদয়ে থাকত সদা জাগরুক। তাই তিনি রাতবিরাতে খুঁজে ফিরতেন অভাবী প্রজাদের। কবির ভাষায় ঐতিহাসিক এমনই এক চিত্র ফুটে ওঠেছে-


ছদ্ববেশী ওই যে পথিক/আঁধার রাতে ঘুরছে ওদিক/অসহায়ের নিচ্ছে খবর পায়ে হেঁটে।/অভাব তাদের করতে পূরণ/খাদেম যে তার সফর আপন/খাদ্য বোঝা পিঠে লয়ে যায় ছুটে।/উটের রজ্জু নিজের করে/গোলাম যে তার পিঠের পরে/আপন বেগে ছুটছে সেজন ভিন দেশে।/আমির ফকির নেই ভেদাভেদ/সত্য ন্যায়ের এই যে শাহেদ/যাচ্ছে আমির ভিন দেশে আজ ফকির বেশে।/সেই তো আমির ওমর ফারুক/খোদার অশেষ রহম ঝড়ুক তার পরে।/বিশ্ব জগৎ তাণ্ডকে খ্ুঁজে/সকাল-বিকাল প্রতি রোজে দুঃখ করে।/অর্ধ জাহান করল শাসন/মাটির তখত তাহার আসন/কী ছিল তার মনের বাসন তাই বলি।/খোদার বিধান বাস্তবায়ন/সৃষ্টি সেবার স্বমূল্যায়ন/তার পায়ে পা রেখে এবার পথ চলি।


জনহিতকর কার্যাবলি


হিজরি সাল প্রবর্তন, শহর নির্মাণ, ইবাদতখানা নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি।


বিশ্ববিজেতা খলিফা ও আদর্শ শাসক, বিশ্বের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় অমর ব্যক্তিত্ব খলিফা ওমর ফারুক (রা.)। তার শাসনামল ইসলামের কৃতিত্বপূর্ণ সামরিক ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি শুধু মহান বিজেতাই নন, যুগশ্রেষ্ঠ শাসক এবং নিরঙ্কুশ সফল খলিফাও। যিনি মাটিতে বিছানো মাদুরের তখতে বসে করেছেন বিশ্ব শাসন। তার ছিল না শাসকসুলভ আলাদা কোনো পোশাক কিংবা সিংহাসন। ছিল না রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে বিলাসী জীবন। বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন অতি সাধারণ একজন মানুষের মতোই জীবন পরিচালনায় অভ্যস্ত, দুনিয়াবিমুখ এক নীরব সাধক। এ মহান খলিফা ২৪ হিজরি ১লা মুহররম মোতাবেক ৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে শাহাদাত বরণ করেন।